অনুবাদ ও সমালোচনা*
অনুবাদকদের কাজ অন্তত কিছুটা যে সমালোককদের মতো এ কথা অনেকেই স্বীকার করবেন । বিশেষত সাহিত্যের অনুবাদের ক্ষেত্রে এ ধারণা বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য। সাহিত্যে অনুবাদকের দায়িত্ব কেবলমাত্র ভাষান্তর নয়। সেই সাহিত্য রচনার এক যথার্থ নতুন রূপ নতুন ভাষায় প্রকাশ করা। কেবল মাত্র ভাষান্তর করলে সাহিত্যে হারিয়ে যায় অনেক কিছু। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষ ভাবে সত্য।এই হারানোর কথাই রবার্ট ফ্রস্ট তার উক্তি "poetry is what gets lost in translation" এ বলেছেন। তাই অনুবাদকের জন্য কেবল ভাষার ওপর দখলই যথেষ্ঠ নয়। চাই মূলভাষ্যের ওপর দখলদারির অধিকার। কাজটি যে দুরূহ বালাই বাহুল্য। এবং প্রায়শই পুরস্কারহীন। কারণ অনুবাদকের প্রাথমিক কাজ মূল ভাষ্যকে অন্য ভাষায় প্রকাশ করা। এই কাজে মূল ভাষ্যের প্রতি সম্মান রাখা যেমন জরুরি , তেমনই জরুরি একটি প্রানবন্ত অনূদিত ভাষ্য তৈরি করা । এর ফলে অনুবাদককে প্রতি পদে মূল ভাষ্যের প্রতি আনুগত্য বনাম অনূদিত ভাষ্যের প্রানবন্ততার এক চিরন্তন বিরোধের সম্মুখীন হয় থাকতে হয়। এই দুরূহ বিরোধ অতিক্রম করার পর অনুবাদকের সামনে আসে সমালোচনা। মূল ভাষ্যের সাথে তুলনা হয় অবশম্ভাবী , যার পরিণতি প্রায়শই সমালোচকের অসন্তুষ্টি । আমার এই প্রতিবেদনে কিছু বিখ্যাত অনুবাদ এবং তার সমালোচনার কথা তুলে ধরব।
অনুবাদের প্রথম যুগে সমালোচনা কেবল অনুবাদের মান বা মূল ভাষ্যের প্রতি তার আনুগত্য নিয়ে হত না। সে সময় অনুবাদের অধিকারও ছিল বিতর্কিত। চোদ্দ শতকের ইংরেজ অনুবাদক উইলিয়াম টিনডেল (William Tyndale ১৪৯৪-১৫৩৬) ছিলেন অসামান্য ভাষাবিদ। গ্রিক এবং হিব্রু সহ সাতটি ভাষায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। তৎকালীন বিখ্যাত ইশ্বরতাত্ত্বিক অক্সফোর্ড-এর জন ওয়াইক্লিফ - এর অনুপ্রেরণায় তিনি বাইবেলের অনুবাদে উদ্যোগী হন। ওয়াইক্লিফ মানে করতেন বাইবেল সাধারন মানুষের জীবনের জন্য প্রযোজ্য, তাই তা সাধারণের কাছে সহজ লভ্য হওয়া উচিত। এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে টিনডেল ১৫২৬ খ্রীস্টাব্দে গ্রিক ও হিব্রু ভাষা থেকে বাইবেল এর ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। এই অনুবাদ ছিল অনুমতিবিহীন। ওয়াইক্লিফের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপের নেতৃত্বে তখন এক অনুশাসন জারি ছিল যার দ্বারা বাইবেলের ইংরাজি অনুবাদ বা তার ইংরাজি পঠন ছিল নিষিদ্ধ। টিনডেলের অনুবাদ ছিল এই অনুশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বাইবেলকে সাধারণ মানুষের থেকে সরিয়ে চার্চের কুক্ষিগত করার প্রয়াসকে ভেঙে দেবার এক প্রচেষ্টা। এই বিদ্রোহের শাস্তিও ছিল ভয়ংকর। ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে টিনডেলকে বিরুদ্ধ বিশ্বাসের অভিযোগে জীবন্ত দগ্ধ করে মারা হয়। তবে টিনডেলের গল্পের এখানেই শেষ নয়। তার মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই বাইবেল অনুবাদ সম্বন্ধিত ধারনার বদল হয়। বর্তমানে প্রচলিত King James Version মূলত টিনডেলের অনুবাদের ভিত্তিতে তৈরি ।
প্রথম যুগের অনুবাদকদের মধ্যে অপর একজন কালজয়ী অনুবাদক ছিলেন এতিয়েন দোলে (Etienne Dolet 1509-1546). তিনি ছিলেন ফরাসি পণ্ডিত, অনুবাদক এবং মুদ্রাকর। অনুবাদতত্ত্বেরও প্রথম যুগের প্রবক্তা ছিলেন এতিয়েন দোলে। তিনি অনূদিত ভাষ্যের মাধুর্যের প্রযোজনীয়তার উপর বিশেষ গুরুত্ত্ব দেন। তার লেখা La maniere de bien traduire d'une langue en autre -এ ("এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় ভালো অনুবাদের উপায়") দোলে পরামর্শ দিয়েছেন যে অনুবাদককে শব্দ এমন ভাবে সাজাতে হবে যে তা যেন আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে। এই জন্য অনুবাদককে সম্পুর্ন ভাবে মূল ভাষ্যটি আত্মস্থ করতে হবে। প্রয়োজন হলে মূল ভাষ্যের অস্পস্টতা দূর করতে হবে। শব্দভিত্তিক অনুবাদের প্রবণতাকে দূর করতে হবে। লাতিনজাত বা অন্যান্য দুর্বোধ্য শব্দ বর্জন করতে হবে। অনুবাদের মধ্যে যেন কোনো জড়তা না থাকে তা দেখতে হবে।
টিনডেলের আলোচনা থেকে এটা পরিস্কার যে তিনি অনুবাদকের কাজকে ভাষা পরিবর্তনের পরিধি থেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন। তার অনুবাদক এক যথার্থ সাহিত্য সমালোচক। দোলে নিজেও তার অনুবাদগুলির ক্ষেত্রে এই আদর্শ অনুসরণ করতেন। প্লেটোর অনুবাদ করার সময় তিনি মৃত্যু সম্বন্ধিত আলোচনায় "কিছুই নেই" (rien du tout) শব্দগুলি যোগ করেন। তৎকালীন সমাজে এর ফলে তিনি নাস্তিকতার প্রচারে অভিযুক্ত হন। তার পারিনীতিও হয় টিনডেলের মতই। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তার মৃত্যুদন্ড হয়।
এক্ষেত্রেও মৃত্যুর পর তার চিন্তা স্বীকৃতি পায়। দোলের পরবর্তী অনুবাদকরা সাবলীল অবাধ অনুবাদ রীতি সাদরে গ্রহন করেন। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায় জর্জ চাপমানের হোমারের (১৬১৬ খ্রি )অনুবাদে। দুশো বছর বাদেও এই অবাধ অনুবাদের প্রশংসা জন কিটসএর On First Looking into Chapman's Homer সনেটে পাওয়া যায়। চ্যাপম্যান বিশ্বাস করতেন অনুবাদকের প্রধান আনুগত্য পাঠকের প্রতি, মূলভাষ্য বা লেখকের প্রতি নয়।
অবাধ অনুবাদের এক অন্যতম প্রবক্তা ফরাসি অনুবাদক নিকোলাস দ্য আব্লাঙ্কুর।তার অনুবাদ সম্বন্ধিত (কিছুটা অবমাননাকর ) উক্তি les belles infideles (সুন্দরী অবিশ্বাসী নারী) আজ-ও অনুবাদের সমালোচনায় বহু ব্যবহৃত। অনুবাদকে নারীদের সাথে তুলনা করে বলছেন যে তারা দুজনে হয় সুন্দরী নয় বিশ্বস্ত, কিন্তু দুই একসাথে কখনই নয়।
অনুবাদের মান নিয়ে সমালোচনা তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয় ওঠে এর পরবর্তী সময়ে । জন ডেনহ্যাম সতের শতকের ইংরেজ কবি ও অনুবাদক নিম্নমানের অনুবাদ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন। তার মতে অনুবাদের দুঃসাহস কেবল তাদেরই করা উচিত যারা মূল লেখকের সমান প্রতিভার অধিকারী
'such is our pride, our folly, or our fate, that few but such as cannot write - translate'
অনুবাদের মাধ্যমে মূলভাষ্যের পরিবর্তনের আরেক অন্যতম উদাহরন ফিতজগেরাল্দের অনুদিত রুবায়িয়াত অফ ওমার খৈয়াম। মূল রচনা ১৫৮ টি আলাদা ফারসী কবিতার সঙ্কলন। ফিতজগেরাল্দের তার অনুবাদে কবিতাগুলি কে বিশেষভবে বিন্যাস করে একটি অখন্ড ইংরাজি কবিতার রূপ দেন । এছাড়াও এই অনুবাদের বিভিন্ন সংস্করণগুলি একে অপরের থেকে আলাদা। বার বার তিনি মূল রচনাকে নতুন করে প্রকাশ করেন। ফিতজগেরাল্দ এ প্রসংগে বলেছিলেন 'better a live sparrow than a stuffed eagle'-- ঈগলের প্রতিকৃতির চেয়ে জ্যান্ত চড়ুই ভালো।
রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ সম্পর্কে দু-একটি কথা বলে এই প্রতিবেদন শেষ করব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের রচনার অনুবাদগুলির , বিশেষত কবিতার অনুবাদগুলির মূল রচনার থেকে পার্থক্য বেশ লক্ষ্যনীয়। প্রায়শই তিনি মূল রচনা থেকে শব্দ, বাক্য এমনকি অনুচ্ছেদ তার ইংরাজি ভাষ্যে বাদ দিয়েছেন বা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তার নিজের রচনার অনুবাদ যে সমালোচনার উর্ধে উঠেছিল তা নয়। এই প্রসঙ্গে অরবিন্দ ঘোষের (১৯৯০) উক্তি এখানে আনা যেতে পারে।
"One has only to compare this English prose, beautiful as it is with the original poetry to see how much has gone out with the change, something is successfully substituted which may satisfy the English reader, but can never satisfy the ear or the mind that once has listened to the singer’s own native and magical verses."
আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদকের কাজ গ্রহন করার পিছনেও তাঁর রচনার তৎকালীন সমালোচনার কিছুটা অবদান আছে। রথেনস্টাইন (দ্র: দাস ১৯৯৫পৃ :১২ ) এই রকম এক প্রচলিত অনুবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে তা 'too monstrously ill done for words'. কিছুটা তার রচনার জনপ্রিয়তা এবং তার প্রচলিত অনুবাদের সমালোচনা তাকে ইংরাজিতে লেখায় বাধ্য করে। এর আগে তিনি বিভিন্ন চিঠি পত্র এবং অন্যান্য লেখায় ইংরাজিতে লেখার ব্যাপারে তার অনিহার কথা বারে বারে বলেছেন। কিন্তু অনুবাদক রবীন্দ্রনাথ ক্রমে তার এই অনিহা কাটিয়ে ওঠেন এবং তা পরিপূর্ণতা পায় তার রচিত কাব্য The Child /শিশুতীর্থতে, যার মূলভাষ্য তিনি ইংরাজিতে লেখেন এবং তা বাংলায় অনুবাদ করেন।
*এই রচনার প্রথম খসড়ার উপর অধ্যাপিকা মিনা দানের পরামর্শ এবং সংশোধনের জন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
উল্লেখপ ঞ্জি :
Das, S. K., 1996, English Writings of Rabindranath Tagore, vol – I-III, Sahitya Aademi, Delhi
অনুবাদকদের কাজ অন্তত কিছুটা যে সমালোককদের মতো এ কথা অনেকেই স্বীকার করবেন । বিশেষত সাহিত্যের অনুবাদের ক্ষেত্রে এ ধারণা বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য। সাহিত্যে অনুবাদকের দায়িত্ব কেবলমাত্র ভাষান্তর নয়। সেই সাহিত্য রচনার এক যথার্থ নতুন রূপ নতুন ভাষায় প্রকাশ করা। কেবল মাত্র ভাষান্তর করলে সাহিত্যে হারিয়ে যায় অনেক কিছু। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে এ কথা বিশেষ ভাবে সত্য।এই হারানোর কথাই রবার্ট ফ্রস্ট তার উক্তি "poetry is what gets lost in translation" এ বলেছেন। তাই অনুবাদকের জন্য কেবল ভাষার ওপর দখলই যথেষ্ঠ নয়। চাই মূলভাষ্যের ওপর দখলদারির অধিকার। কাজটি যে দুরূহ বালাই বাহুল্য। এবং প্রায়শই পুরস্কারহীন। কারণ অনুবাদকের প্রাথমিক কাজ মূল ভাষ্যকে অন্য ভাষায় প্রকাশ করা। এই কাজে মূল ভাষ্যের প্রতি সম্মান রাখা যেমন জরুরি , তেমনই জরুরি একটি প্রানবন্ত অনূদিত ভাষ্য তৈরি করা । এর ফলে অনুবাদককে প্রতি পদে মূল ভাষ্যের প্রতি আনুগত্য বনাম অনূদিত ভাষ্যের প্রানবন্ততার এক চিরন্তন বিরোধের সম্মুখীন হয় থাকতে হয়। এই দুরূহ বিরোধ অতিক্রম করার পর অনুবাদকের সামনে আসে সমালোচনা। মূল ভাষ্যের সাথে তুলনা হয় অবশম্ভাবী , যার পরিণতি প্রায়শই সমালোচকের অসন্তুষ্টি । আমার এই প্রতিবেদনে কিছু বিখ্যাত অনুবাদ এবং তার সমালোচনার কথা তুলে ধরব।
অনুবাদের প্রথম যুগে সমালোচনা কেবল অনুবাদের মান বা মূল ভাষ্যের প্রতি তার আনুগত্য নিয়ে হত না। সে সময় অনুবাদের অধিকারও ছিল বিতর্কিত। চোদ্দ শতকের ইংরেজ অনুবাদক উইলিয়াম টিনডেল (William Tyndale ১৪৯৪-১৫৩৬) ছিলেন অসামান্য ভাষাবিদ। গ্রিক এবং হিব্রু সহ সাতটি ভাষায় তিনি পারদর্শী ছিলেন। তৎকালীন বিখ্যাত ইশ্বরতাত্ত্বিক অক্সফোর্ড-এর জন ওয়াইক্লিফ - এর অনুপ্রেরণায় তিনি বাইবেলের অনুবাদে উদ্যোগী হন। ওয়াইক্লিফ মানে করতেন বাইবেল সাধারন মানুষের জীবনের জন্য প্রযোজ্য, তাই তা সাধারণের কাছে সহজ লভ্য হওয়া উচিত। এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে টিনডেল ১৫২৬ খ্রীস্টাব্দে গ্রিক ও হিব্রু ভাষা থেকে বাইবেল এর ইংরাজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। এই অনুবাদ ছিল অনুমতিবিহীন। ওয়াইক্লিফের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যান্টারবেরির আর্চবিশপের নেতৃত্বে তখন এক অনুশাসন জারি ছিল যার দ্বারা বাইবেলের ইংরাজি অনুবাদ বা তার ইংরাজি পঠন ছিল নিষিদ্ধ। টিনডেলের অনুবাদ ছিল এই অনুশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। বাইবেলকে সাধারণ মানুষের থেকে সরিয়ে চার্চের কুক্ষিগত করার প্রয়াসকে ভেঙে দেবার এক প্রচেষ্টা। এই বিদ্রোহের শাস্তিও ছিল ভয়ংকর। ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে টিনডেলকে বিরুদ্ধ বিশ্বাসের অভিযোগে জীবন্ত দগ্ধ করে মারা হয়। তবে টিনডেলের গল্পের এখানেই শেষ নয়। তার মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই বাইবেল অনুবাদ সম্বন্ধিত ধারনার বদল হয়। বর্তমানে প্রচলিত King James Version মূলত টিনডেলের অনুবাদের ভিত্তিতে তৈরি ।
প্রথম যুগের অনুবাদকদের মধ্যে অপর একজন কালজয়ী অনুবাদক ছিলেন এতিয়েন দোলে (Etienne Dolet 1509-1546). তিনি ছিলেন ফরাসি পণ্ডিত, অনুবাদক এবং মুদ্রাকর। অনুবাদতত্ত্বেরও প্রথম যুগের প্রবক্তা ছিলেন এতিয়েন দোলে। তিনি অনূদিত ভাষ্যের মাধুর্যের প্রযোজনীয়তার উপর বিশেষ গুরুত্ত্ব দেন। তার লেখা La maniere de bien traduire d'une langue en autre -এ ("এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় ভালো অনুবাদের উপায়") দোলে পরামর্শ দিয়েছেন যে অনুবাদককে শব্দ এমন ভাবে সাজাতে হবে যে তা যেন আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে। এই জন্য অনুবাদককে সম্পুর্ন ভাবে মূল ভাষ্যটি আত্মস্থ করতে হবে। প্রয়োজন হলে মূল ভাষ্যের অস্পস্টতা দূর করতে হবে। শব্দভিত্তিক অনুবাদের প্রবণতাকে দূর করতে হবে। লাতিনজাত বা অন্যান্য দুর্বোধ্য শব্দ বর্জন করতে হবে। অনুবাদের মধ্যে যেন কোনো জড়তা না থাকে তা দেখতে হবে।
টিনডেলের আলোচনা থেকে এটা পরিস্কার যে তিনি অনুবাদকের কাজকে ভাষা পরিবর্তনের পরিধি থেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন। তার অনুবাদক এক যথার্থ সাহিত্য সমালোচক। দোলে নিজেও তার অনুবাদগুলির ক্ষেত্রে এই আদর্শ অনুসরণ করতেন। প্লেটোর অনুবাদ করার সময় তিনি মৃত্যু সম্বন্ধিত আলোচনায় "কিছুই নেই" (rien du tout) শব্দগুলি যোগ করেন। তৎকালীন সমাজে এর ফলে তিনি নাস্তিকতার প্রচারে অভিযুক্ত হন। তার পারিনীতিও হয় টিনডেলের মতই। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তার মৃত্যুদন্ড হয়।
এক্ষেত্রেও মৃত্যুর পর তার চিন্তা স্বীকৃতি পায়। দোলের পরবর্তী অনুবাদকরা সাবলীল অবাধ অনুবাদ রীতি সাদরে গ্রহন করেন। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায় জর্জ চাপমানের হোমারের (১৬১৬ খ্রি )অনুবাদে। দুশো বছর বাদেও এই অবাধ অনুবাদের প্রশংসা জন কিটসএর On First Looking into Chapman's Homer সনেটে পাওয়া যায়। চ্যাপম্যান বিশ্বাস করতেন অনুবাদকের প্রধান আনুগত্য পাঠকের প্রতি, মূলভাষ্য বা লেখকের প্রতি নয়।
অবাধ অনুবাদের এক অন্যতম প্রবক্তা ফরাসি অনুবাদক নিকোলাস দ্য আব্লাঙ্কুর।তার অনুবাদ সম্বন্ধিত (কিছুটা অবমাননাকর ) উক্তি les belles infideles (সুন্দরী অবিশ্বাসী নারী) আজ-ও অনুবাদের সমালোচনায় বহু ব্যবহৃত। অনুবাদকে নারীদের সাথে তুলনা করে বলছেন যে তারা দুজনে হয় সুন্দরী নয় বিশ্বস্ত, কিন্তু দুই একসাথে কখনই নয়।
অনুবাদের মান নিয়ে সমালোচনা তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয় ওঠে এর পরবর্তী সময়ে । জন ডেনহ্যাম সতের শতকের ইংরেজ কবি ও অনুবাদক নিম্নমানের অনুবাদ নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন। তার মতে অনুবাদের দুঃসাহস কেবল তাদেরই করা উচিত যারা মূল লেখকের সমান প্রতিভার অধিকারী
'such is our pride, our folly, or our fate, that few but such as cannot write - translate'
অনুবাদের মাধ্যমে মূলভাষ্যের পরিবর্তনের আরেক অন্যতম উদাহরন ফিতজগেরাল্দের অনুদিত রুবায়িয়াত অফ ওমার খৈয়াম। মূল রচনা ১৫৮ টি আলাদা ফারসী কবিতার সঙ্কলন। ফিতজগেরাল্দের তার অনুবাদে কবিতাগুলি কে বিশেষভবে বিন্যাস করে একটি অখন্ড ইংরাজি কবিতার রূপ দেন । এছাড়াও এই অনুবাদের বিভিন্ন সংস্করণগুলি একে অপরের থেকে আলাদা। বার বার তিনি মূল রচনাকে নতুন করে প্রকাশ করেন। ফিতজগেরাল্দ এ প্রসংগে বলেছিলেন 'better a live sparrow than a stuffed eagle'-- ঈগলের প্রতিকৃতির চেয়ে জ্যান্ত চড়ুই ভালো।
রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ সম্পর্কে দু-একটি কথা বলে এই প্রতিবেদন শেষ করব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের রচনার অনুবাদগুলির , বিশেষত কবিতার অনুবাদগুলির মূল রচনার থেকে পার্থক্য বেশ লক্ষ্যনীয়। প্রায়শই তিনি মূল রচনা থেকে শব্দ, বাক্য এমনকি অনুচ্ছেদ তার ইংরাজি ভাষ্যে বাদ দিয়েছেন বা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তার নিজের রচনার অনুবাদ যে সমালোচনার উর্ধে উঠেছিল তা নয়। এই প্রসঙ্গে অরবিন্দ ঘোষের (১৯৯০) উক্তি এখানে আনা যেতে পারে।
"One has only to compare this English prose, beautiful as it is with the original poetry to see how much has gone out with the change, something is successfully substituted which may satisfy the English reader, but can never satisfy the ear or the mind that once has listened to the singer’s own native and magical verses."
আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদকের কাজ গ্রহন করার পিছনেও তাঁর রচনার তৎকালীন সমালোচনার কিছুটা অবদান আছে। রথেনস্টাইন (দ্র: দাস ১৯৯৫পৃ :১২ ) এই রকম এক প্রচলিত অনুবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন যে তা 'too monstrously ill done for words'. কিছুটা তার রচনার জনপ্রিয়তা এবং তার প্রচলিত অনুবাদের সমালোচনা তাকে ইংরাজিতে লেখায় বাধ্য করে। এর আগে তিনি বিভিন্ন চিঠি পত্র এবং অন্যান্য লেখায় ইংরাজিতে লেখার ব্যাপারে তার অনিহার কথা বারে বারে বলেছেন। কিন্তু অনুবাদক রবীন্দ্রনাথ ক্রমে তার এই অনিহা কাটিয়ে ওঠেন এবং তা পরিপূর্ণতা পায় তার রচিত কাব্য The Child /শিশুতীর্থতে, যার মূলভাষ্য তিনি ইংরাজিতে লেখেন এবং তা বাংলায় অনুবাদ করেন।
*এই রচনার প্রথম খসড়ার উপর অধ্যাপিকা মিনা দানের পরামর্শ এবং সংশোধনের জন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
উল্লেখপ ঞ্জি :
Ghosh,
A., 1990, ‘On Tagore’, in Golden Book of Tagore, Calcutta: The Golden Book of
Tagore Committee, 1931, reprint. Caslcutta: Rammohan Library and Free Reading
Room 1990
Das, S. K., 1996, English Writings of Rabindranath Tagore, vol – I-III, Sahitya Aademi, Delhi
লেখক পরিচিতি
:
অদিতি ঘোষ , ভাষাতত্ত্ব বিভাগ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
aditi.gh@caluniv.ac.in
No comments:
Post a Comment